ছোটগল্প - মিথ্যে ভালবাসা
মোহন দাস
|| ১ ||
বিয়ে করে বউ ঘরে আনার পর, ঘরে দুটি খাট হয়ে যায় । একটি তুহিনের । অন্যটি ওর বউ তমশ্রীর । তমশ্রীর গায়ের রং দুধের মতো সাদা । এক পিঠ কুঁকড়ানো চুল । যেমন লম্বা, তেমন চওড়া একদম ইংরেজি সিনেমার নায়িকার মতন । বাসর ঘরে গোলাপের গন্ধ মম করছে । শীতকাল । রাত্রি অনেক হয়েছে । কোথাও কোনও সারাশব্দ নেই । অনেকক্ষণ পর তমশ্রী খানিকটা বিস্ময় এবং হতাশা নিয়ে বলল,
“আজ কি আমরা আলাদা বিছানায় ঘুমোবো ? “
তুহিন নিজের বিছানা ঠিক করছিল । থেমে গেল । ঘড়ির শব্দ টিক টিক টিক করে বাজছে । কিন্তু তুহিন কোনও কথা বলল না । আবার বিছানা ঠিক করতে লাগল । তুহিন যেন অদ্ভুত প্রকৃতির । কখনও হাসে না । সবসময় যেন কীসব চিন্তা করতে থাকে । দিন রাত কাগজে কী সব লিখতে থাকে । মাসে এক আধদিন বাজার থেকে গাদা খানেক বই কিনে আনে । সঙ্গে কাগজ, কলম ।
ঘরে দুটো বড় বড় বইয়ের তাক প্রায় ভর্তি বইয়ে । আসবাব বলতে বিয়েতে পাওয়া খাট, আলমারি ও ড্রেসিং টেবিল । তুহিন বিয়েতে কিছুই চাইনি । কিন্তু শশুর মহাশয়ের জোড়ে জোড় খাটেনি একটুও ।
তুহিনের বয়েস ত্রিশ এর কাছাকাছি । গাল ভর্তি দাঁড়ি । শ্যাম বর্ণ । প্রায় ছয় ফুট মতন লম্বা । লোকে বলত, “এত উচ্চতা নিয়ে পুলিশের লাইনে যা, কিছু করতে পারবি ।“ সে কথা তুহিনের কানের কাছে আজও প্রতিধ্বনিত হয় । টিকটিকি ডেকে ওঠে । তুহিন তমশ্রীর কথাটা এড়াতে পারে না । আজ বাসর রাত । দুজন আলাদা বিছানায় শুয়ে । তুহিনের ইচ্ছেও হয়, ওকে ভালবাসতে, আদর করতে । কিন্তু পারে না । ইচ্ছে ছিল এই দিনটাতে সারারাত দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গল্প করবে, ভালবাসবে । ভাবতে ভাবতে পুরনো সেই দিনটাতে ফিরে যায় তুহিন । ঘরে ক্যান্ডেল লাইট জ্বলতে থাকে ।
তমশ্রী বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে । একটা অপরাধ বোধ ওকে চিৎকার করতে বাধা দেয় । কিন্তু কী সেই অপরাধ ? বাইরে বিকট শব্দে প্যাঁচা ডেকে ওঠে । তমশ্রীর বাসর রাত, সাজ-সজ্জা কেমন যেন নাটকীয়তা মনে হতে থাকে । কিন্তু তুহিনের এরকম আচরণের কারণ কী ? তমশ্রীকে পছন্দই যখন না, তখন বিয়ে করল কেন ! আমরা কিছুই বুঝতে পারি না । অথচ তমশ্রী সব বুঝতে পারে । ও চাইলেও এখন আর এইসব ঠিক করতে পারবে না ।
এইভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল । তমশ্রীও অনেকটা সহে গেল । এবং বুঝতে পারল নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে । কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে সে কীই বা করতে পারে । একবার ভাবে, তুহিনের পায়েধরে কাঁদবে, ক্ষমা চায়বে । একবার ভাবে, ওকে দ্বিতীয়বার চিরদিনের জন্য ছেড়ে যাবে । কিন্তু বহুবার যেতে গিয়েও ফিরে ফিরে এসেছে তম । তুহিন তমশ্রীকে তম বলে ডাকত একদিন, এক সময় । আর তমশ্রী তুহিনকে তুহি তুহি বলে ডাকত একদিন ।
রবিবার, তুহিন বাড়িতে নেই । রবিবারে ও সারাদিন বাড়ি থাকে না । সকাল সাতটাই স্নান সেরে, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে । কোথায় যায়, তমশ্রীকে তা বলে যায় না । রবিবার এলে তমশ্রীও যেন একটু স্বাধীন হয় । তুহিন বাড়িতে থাকলে, ওর যেন চলতে, কথা বলতে, খেতে, হাসতে, বাঁধো বাঁধো ঠাকে । কিন্তু আজ তেমন হবার অবকাশ নেই । জানালার ধারে বসে থাকে তমশ্রী । বাইরের সজনে গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে ওর বুকে, মুখের এক ধারে । একদিন এই গায়ে তুহিনও কতবার আছড়ে আছড়ে পড়েছে । দূরের কোনও গাছ থেকে একটা ঘুঘু মাঝে মাঝেই ডেকে উঠছে । দুপুর হয়ে এসেছে প্রায় । তমশ্রী একা বসে থাকে । ভাবে, “জীবনের রং যেন ফিকে হয়েছে এসেছে । সিঁথিতে সিঁদুর, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, লাল শাড়ি পরেও নিজেকে কেমন যেন রং চটা গিটার মনে হয় । যাকে টিউন করে বাজালে বেশ সুর ওঠে । কিন্তু বাজানোর লোক নেই । সেই সুর শোনার লোক নেই কোথাও ।“
ক্রমে রাত হয়ে আসে । তুহিন বাড়িতে এলে আচমকা তমশ্রী বলে,
“কেমন আছ তুহি ?”
এই প্রশ্নে তুহিন আবার থমকে যায় । কোনও উত্তর দেয় না এবারেও । মনে মনে কেঁদে ফুঁপিয়ে ওঠে তুহিন । দুচোখ ছলছল করে ওর । এরকম প্রশ্ন আমাদেরকেও ভাবায় । যার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয় তাকে “কেমন আছ” জিজ্ঞাসা করার কী মানে ? কখনও কখনও কোনও কোনও কথার বাহ্যিক কোনও মানে থাকে না আসলে । তবে এখানে মানেটা দুটি মনের । দুটি প্রেমিকের ।
তমশ্রী উত্তর না পেয়েও আবার জিজ্ঞাসা করে, এবার একটু পরিচিত নরম সুরে,
“তুহি, দুপুরে ঠিক করে খেয়েছিলে ? আমি ডিমটোস্ট রেখেছি, খাবে ?”
তুহিন উত্তর দেয় না । নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে ।
|| ২ ||
তুহিনের উত্তর না দেবার কারণ – পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনা । যেখানে তমশ্রীই ছিল মূল । তবে তখন দুজনের জীবনেই অন্ধকার নেমে আসে । হঠাৎই দুজনের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে, বিচ্ছেদটা ঝড়ের মতন আছড়ে পড়ে ।
বেশ কয়েক মাস পর থেকে তমশ্রী ধীরে ধীরে সেই অন্ধকার কাটিয়েও ফেলতে পারে । এবং এক সময় তুহিনকে পুরোপুরিই ভুলে যায় । বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে এখন বেশ দিন কাটছে ওর । তমশ্রীর এক খুব কাছের বন্ধু শুভ্র, ওর সাথে তমশ্রীর বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়ে এসেছে বিচ্ছেদের পর । মনে মনে শুভ্রর প্রতি এখন একটু দুর্বলতাও অনুভব করে তমশ্রী । কিন্তু সে শপথ নিয়েছে, জীবনে দ্বিতীয়বার কাউকে ভালবাসবে না । তবে তমশ্রী জানে শুভ্র তেমন খারাপ ছেলে নয় । ওর মতো ডিসেন্ট ছেলে এ বয়েসে আজকাল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । কিন্তু তুহিনও তো ডিসেন্ট ছিল ! তমশ্রীর বুকটা ধক করে ওঠে । ভাবে, “আজ মানুষ মানুষকে চায় রুটি, ভাতের মতোই । কিন্তু এই খিদে কেউ বোঝে না । এ শহর ভালবাসাহীনতায় ভুগছে । মানুষও । তবু ভুলবশত এই অসুখ, এই ক্ষুধা যাঁরা বুঝে ফেলে তাঁরা তো মানুষের পাশে দাঁড়ায় ভালবাসা দিতে নয়, ভালবাসা কেড়ে নিতে । ভালবাসার নামে আজ লুট চলছে এই শহর জুড়ে । ভালবাসা যেমন মানুষকে ধনী করে তোলে তেমনই কাঙালও তো করে দেয় যদি সেই ভালবাসা মিথ্যা হয় । আমিও আজ কাঙাল, বড্ড কাঙাল ।“
তবুও মাঝে মাঝে তুহিনের জন্য মন খারাপ হয় । আজও পম্পা তমশ্রীকে বলে,
“নতুন করে নতুন কাউকে ভালবাস, নতুন ভালবাসাই তোকে বাঁচতে শেখাবে । নতুনের ভালবাসা পেলে তুই ওকে সম্পূর্ণ ভুলে যাবি দেখিস । “
কিন্তু তমশ্রী মৃদু বিরহের সঙ্গে পম্পাকে প্রতিবার বলে,
“যে মানুষ দেহের প্রত্যেকটা রোমকূপে গেঁথে আছে, মনের প্রত্যেকটা ভাঁজে ভাঁজে যে মানুষের অবাধ বিচরণ । তাকে ভুলতে পারা আর নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে না পারা একই বিষয় । “
পম্পা কিছু বুঝতে পারে না । তবুও সেদিন পম্পার কাছেই কেঁদে কেঁদে বলেছিল তমশ্রী,
“তুহিন ভাল না জানিস পম্পা, আমাকে আগের মতন ভালবাসে না । আমার প্রতি ওর কোনও খেয়াল নেই । আমার সঙ্গে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলে না । আমি ওকে কত ভালবাসি…”
ভালবাসার কোনও সংজ্ঞা হয় না । তবে ভালবাসা কথাটির ভেতরেই লুকিয়ে থাকে স্নেহ, মায়া, আদর । কিন্তু সব মানুষের তা চোখে পড়ে না । যাঁরা বুকে প্রেমের পাহাড় নিয়ে জন্মায়, কেবল তাঁরাই জানতে পারে । কিন্তু তুহিন প্রেম নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছিল না কি অবহেলা ? তমশ্রী বুঝতে পেরেছিল, ভালবাসারও বয়েস হয়, তারও যৌবন হারিয়ে যায় । সবসময় তারও উত্তেজনা থাকে না । আর তুহিনের জীবন থেকে উত্তেজনা হারিয়ে গেছে । যদিও এর কারণটা জানে তমশ্রী । সে বুঝতে পারে, প্রেম এমন একটা গন্ধ যাকে গায়ে মাখলেই নষ্ট হয়ে যায়; অথচ সেই গন্ধের এতটাই তীব্রতা যে, একবার শুকে ফেললেই সাধারণ জ্ঞান হারিয়ে যায় । উন্মাদ হয়ে ওঠে মানুষ । গায়ে মাখতে চায় ।
পম্পা, তমশ্রীর স্কুল জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী । যে কোনও বিপদে-আপদে তমশ্রী একমাত্র এই পম্পাকেই পাশে পায় । পম্পার মতন মানুষ পাশে থাকলে, আর কাউকেই প্রয়োজন হয় না । তবুও দৈহিক প্রয়োজনে এবং কিছুটা পারিবারিক প্রয়োজনে তুহিনকে ভালবেসেছিল তমশ্রী । কিন্তু আজ সে নেই । এই বিরহের দিনে পম্পাই তমশ্রীর পাশে, মায়ের মতন দাঁড়িয়েছে । বুঝিয়েছে । কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেম, এত সহজেই কি ভোলা যায় ! এইরকম ভাবেই কয়েকটা মাস পার হয়ে গেল । মাসগুলো যেন এক একটা শতাব্দী । কিছুতেই যেতে চায়নি, তমশ্রীকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তুহিনের কাছে । কিন্তু শেষমেশ পম্পার সেই কথাটিই যেন তমশ্রীকে ভাবিয়ে তোলে, তমশ্রী ভাবে, “আচ্ছা নতুন কাউকে ভালবাসলে কি সত্যি তুহিনকে ভোলা সম্ভব ?”
আরও কিছু মাস যেতে যেতে, শুভ্র যেন তমশ্রীর নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে । ওর সঙ্গে কথা না বললে, এক মুহূর্ত থাকতে পারে না তমশ্রী । কিন্তু তমশ্রীর মনে মনে শুভ্রর প্রতি এত প্রেম, এত চাওয়া, শুভ্র বিন্দু মাত্র বুঝতে পারে না । কিন্তু পম্পা কিছুটা আন্দাজ করেছিল । সে এটাই চায় যে, তমশ্রী সবকিছু ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসুক । অন্য কেউ তার কাঙ্খিত ভালবাসা দিক ।
একদিন সন্ধ্যাবেলা স্টেশনে, হঠাৎ শুভ্রর সঙ্গে দেখা তমশ্রীর । শুভ্রর সঙ্গে এর আগে একা কখনও দেখা সাক্ষাৎ করেনি ও । তমশ্রী, শুভ্রকে দেখেই এক প্রকার লজ্জা অনুভব করতে থাকে । কিন্তু তবুও তাকে ডাকে,
“শুভ্র .. এই শুভ্র…”
শুভ্র পিছন ঘুরেই তমশ্রীকে দেখতে পায়, নীল রঙের একটা ঘাগড়া পড়েছিল তমশ্রী । তমশ্রীর যে উচ্চতা তাতে যে কোনও পোশাকেই তাকে অপরূপ দেখতে লাগে । ঠোঁটে হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক, কানে বড় বড় দুল, হাতে কাঁচের চুড়ি । শুভ্র যেন কিছুক্ষণ ধরে তমশ্রীকে দেখতে থাকল । ভাবল, “এইরকম একটি মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে জীবন সত্যি ধন্য হত ।“ তমশ্রী শুভ্রকে চমকে দিয়ে আবার বলে,
“আরে, কী হল ? কোথায় গেছিলিস ?”
পরবর্তী ট্রেনের অনাউন্স বেজে ওঠে । একটি বাদাম বিক্রেতা হাকতে হাকতে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । শুভ্র মৃদু হেসে বলে,
“হ্যাঁ, এইত । এই একটু দিদার বাড়ি গেছিলাম । তুমি কোথাও গেছিলে ? না কি যাচ্ছ ?”
কথা বলার পর শুভ্র লক্ষ্য করে, তমশ্রীকে সে ‘তুমি’ বলে ফেলেছে । তুই করে বলে সবসময়, কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত রকমের আজকের এই সময়টা; মনে হতে থাকে ওর । তমশ্রী নম্র ভাবেই বলে,
“শুভ্র, এখন কি তুই ফাঁকা আছিস ?”
শুভ্র মনে মনে ভাবে, “কোন ফাঁকা থাকার কথা বলছে তমশ্রী ? আমি সিঙ্গেল আছি না কি এই মুহূর্তে ফ্রি আছি কি না, তার কথা বলছে ?” তবু ঝট করে বলেই ফেলে,
“হ্যাঁ, কেন ?”
তমশ্রী মৃদু স্বরে বলে,
“তোকে আমার কিছু কথা বলার ছিল । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, কবে কোথায় কীভাবেই বা বলব ।“
ওরা দুজনে স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল । পাশ দিয়ে তীব্র হুইসেল বাজাতে বাজাতে একটা মেইল ট্রেন ঝম ঝম করতে করতে চলে গেল । স্টেশনে যাত্রী ভরে উঠল । ওদের কথা বলতে এক প্রকার অসুবিধা হচ্ছিল । শুভ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
“তমশ্রী, চল ফাঁকা কোনও জায়গায় দাঁড়ায় । যা বলার, সেখানেই বলিস ।“
তমশ্রী এক পায়ে রাজি, শুভ্রকে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে বলে,
“ক্যাফে অন টপ ?”
শুভ্র সংক্ষেপে হুম বলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যায় । হঠাৎ মোটরসাইকেল নিয়ে এসে তমশ্রীকে নিয়ে চলে যায় । ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেলের ধোয়া আর ল্যাম্প পোস্টের আলোতে দূরে দেখা যায় তমশ্রীর নীল রঙের পিঠ, কোমর পর্যন্ত নেমে যাওয়া কুঁকড়ানো চুল, চলে যাচ্ছে আরও দূর ।
|| ৩ ||
এরমধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেছে । এই পাঁচ বছরে তুহিন, বহু চেষ্টা করার পরেও চাকরি জোটাতে পারেনি । এজন্যই তার একটু দুঃখ হয় । তাছাড়া তমশ্রীকে ভুলেছে বিচ্ছেদের কয়েক মাস পরেই । তবে তুহিন বিশ্বাস করত একদিন তমশ্রী ঠিক ফিরে আসবে । কিন্তু পাঁচটা বছর হয়ে গেল, সে খোঁজও নেয়নি । ফিরে আসা তো দূর । মানুষ এত তাড়াতাড়ি মানুষকে ভুলতে পারে, সেটা তমশ্রীকে দেখলেই প্রমাণ হয়ে যায় । আসলে প্রয়োজন ফুরোলে, প্রিয়জন ঝিনুকের খোলের মতোই বেলাভূমিতে পড়ে থাকে । দেখেও না দেখার ভান করে; পায়ের তলায় পিষে ফেলতে চায় সবাই ।
তুহিন একজন কবি । বেশ কয়েকটা বইও প্রকাশিত হয়েছে তার । গত বছরে প্রকাশিত একটা কবিতার বই – “যে কবিতা তোমাকে খোঁজে” ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে । পাঠক মহলে এখন তার খুবই নাম । তার আগের বইগুলিও বেস্ট সেলিং এর তকমা পেয়েছে । বহু প্রতিষ্ঠান থেকে বহু সম্মান এবং পুরস্কারও পেয়েছে সে । ছয় মাস পর পরই প্রকাশক নিজে বাড়িতে এসে, বই বিক্রির টাকা দিয়ে যান । মাস শেষে বেশ কিছু পত্রিকায় লিখেও ভাল টাকা পকেটে চলে আসে ওর ।
সরকারি চাকরি পেল না বলে, লেখালেখিতেই মনোনিবেশ করেছিল বেশ করে । এটা জেনেও যে, লিখে কেউ জীবন চালাতে পারে না । লেখা, ভাত জোগাতে পারে না । কিন্তু আজ হাসি পায় তুহিনের । এইত বেশ জোগাছে । তবে, পাশাপাশি একটা প্রেসে কাজও করে তুহিন । সেখান থেকেও বেশ কিছু টাকা পায় । বিচ্ছেদের কয়েক মাস পরই, তুহিন নিজের ভুল বুঝে তমশ্রীর কাছে ফিরে যেতে চেয়েছিল । চেয়েছিল, আবার নতুন করে শুরু করতে । বহুবার তমশ্রীকে মানাতেও চেয়েছিল । কিন্তু তমশ্রী তাকে প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করেছে । তুহিন ভাবতে পারে না, একটা মানুষ হঠাৎ কীভাবে এতটা বদলে যেতে পারে ।
যাইহোক, ব্যস্ততা তুহিনকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল । যে থাকতে চায় না, তাকে বেঁধেও তো রাখা যায় না । তবুও অনেক স্বপ্ন দেখেছিল তমশ্রীকে নিয়ে । ভেবেছিল, তমশ্রীকে বিয়ে করবে, একটা সুখের সংসার গড়বে । কিন্তু এইসব স্বপ্ন, ভাবনা এখন ধূসর বালি । তুহিন শপথ নিয়েছিল, তমশ্রীকে না পেলে আর কাউকেই ভালবাসবে না, আর কাউকে বিয়েও করবে না । আর করলও তাই, বিচ্ছেদের পাঁচ বছর পরেও তুহিন একা । ওর বয়েস হল প্রায় ত্রিশের কাছাকাছি । তমশ্রীরও বয়েস বোধহয় পঁচিশ হল । হয়তো, বিয়ে করে এতদিনে ওর দুটো সন্তানও হয়ে গেছে । তুহিন ভাবতে থাকে । কিন্তু মন খারাপ হয় না মোটেও ।
তুহিনের এক বন্ধু রঞ্জিত । ও ভালবাসতো তমশ্রীরই এক বান্ধবী, রশ্নিকে । রশ্নিও রঞ্জিতকে খুব ভালবাসতো । ওদের সম্পর্কটা ছিল প্রায় সাত বছরের । তুহিনের বিচ্ছেদের কিছু আগে ওরা বিয়ে করে । কই ওরা তো অসুখে নেই । রঞ্জিতের আর্থিক অবস্থাও তো তুহিনের থেকে খুব বেশি ভাল ছিল না । কই রশ্নি তো তাকে ছেড়ে যায়নি । ভালবাসা এমনই হয় । যে টাকা পয়সা ধন দৌলত দেখে ভালবাসে, সে মানুষটিকে ভালবাসে না । তাই তমশ্রী সহজেই তুহিনকে ছাড়তে পেরেছে । কই তুহিন তো ছাড়তে পারেনি । লুকিয়ে লুকিয়ে আজও কাঁদে তুহিন । কিন্তু মেনে নেয়, সে ভুলে গেছে তমশ্রীকে ।
একদিন তুহিন বলেছিল, “তোমার জন্য আলাদা বাড়ি বানাব, তোমার জন্য গাড়ি কিনে দেব, অনেক গহনা থাকবে তোমার । আমাদের সংসারে কোনও অভাবের ছায়া পড়তে দেব না ।” এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই তুহিনের চোখে জল চলে আসে । বুকের বাঁ দিকটায় ব্যথা অনুভব করে । কিন্তু তমশ্রী তো ওকে ভুলেই গেছে । নিশ্চই বিয়ের পর ওউ সুখে নেই ! জানতে বড় ইচ্ছে হয় তুহিনের । আর তারপরই হঠাৎ একদিন তমশ্রীকে দেখা যায় তুহিনের বউ হিসেবে । তমশ্রী অবিবাহিতই ছিল । তবে সে তুহিনের জন্য অপেক্ষা করছিল না । শুভ্রর সঙ্গে মিশে এটুকু বুঝতে পেরেছিল সে, ধন-দৌলত থাকলেও সব মানুষ ভালবাসতে পারে না । সব মানুষ ভালবাসার যোগ্যতাও রাখে না ।
যাইহোক, তমশ্রী দ্বিতীয়বার তুহিনকে পেয়ে বেশ খুশি হয় । বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তুহিনের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষ মুছে গেছিল । যখন স্বামী হিসেবে তুহিনকে পেয়েছে তখন তার প্রতি ঘৃণা রেখে লাভও নেই । কিন্তু তুহিনের মনে তখনও তমশ্রীর প্রতি স্বার্থপরতার ভাব দেখা যায় এবং কিছুটা রাগ এবং অভিমানও । তমশ্রীকে একপ্রকার শাস্তি দেবার জন্যই বিয়ে করে তুহিন । কিন্তু এইভাবে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার তো কোনও মানে হয় না । তুহিন যে কষ্টটা পেয়েছে পাঁচ বছর ধরে, সে চায় সেই কষ্টটা তমশ্রীও বুঝুক । আর এ জন্যই তমশ্রীর সঙ্গে কথা বলে না তুহিন । এমনকি বিয়ের পর কিছু মাস পেরিয়ে গেছে আজও তমশ্রীকে ছুঁইনি তুহিন । শুধু প্রথম দিনের মতন সেই উত্তাল করা ইচ্ছে তাকে দেখবার, তাকে ছোঁবার, তা অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে ।
আর এই জন্যই তমশ্রী কষ্ট পায় । প্রতি রাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে । কবে বুঝবে তুহিন ! তমশ্রীর স্বপ্ন ভেঙে যায় দ্বিতীয়বারও ।
|| ৪ ||
তবে বিয়ের বিয়ের পাঁচ বছর এবং বিচ্ছেদের চার বছর আগে এইরকমটা ছিল না । দুজন দুজনকে এতটা ভালবাসতো যে, আর পাঁচটা সম্পর্ক ওদের সম্পর্কের কাছে ম্লান হয়ে যায় । তমশ্রী আর তুহিনের এইসব স্বপ্ন একদি, পাখির মতন কলকাকলিতে ভরিয়ে দিত সকাল ।
তুহিন তমশ্রীকে প্রথম দেখেছিল কোনও এক রাস্তার মোড়ে । তমশ্রীর তখন বয়েস ষোলো হবে । তুহিনের একুশ মতন । তুহিন একলা থাকতো, সবসময় ভাবত, এমন একটা মানুষ প্রয়োজন যাকে সে প্রচুর ভালবাসবে । সেও যেন পৃথিবীর সব ভালবাসা দিয়ে তাকে ভরিয়ে তোলে । আর পেলও তেমন মেয়ে, তমশ্রীকে । যে মেয়েটিও চেয়েছিল এরকম একটি ছেলেকে যে সবথেকে বেশি তাকেই ভালবাসবে ।
তারপর কিছু মাস যেতে না যেতেই তুহিন সেই মেয়েটির প্রতি ভালবাসা অনুভব করতে থাকে । তাকে পেতে চায় । তাকে পেলেই তার জীবন সার্থক হবে । সত্যি সত্যিই তুহিনের জীবনে একজন ভালবাসার মানুষের প্রয়োজন ছিল । একদিন তুহিন একটা চিরকুটে তার মনের সব কথা, সব অভিপ্রায় লিখে তমশ্রীকে পাঠাল । তমশ্রী তখন প্রেমের প’ও বোঝে না । রাস্তায় দেখে বটে কিন্তু ওর সেইসব আদিখ্যেতা পছন্দ না । ও কখনও প্রেম ভালবাসায় জড়াতে চায় না । বান্ধবীদের কাছে শুনেছে, ছেলেরা নাকি মেয়েদের সঙ্গে ‘ওইসব’ করে । আর তারপর ছেড়ে দেয় । এজন্য তমশ্রী ভয়ে ভয়ে থাকে । যদি কোনও ছেলে তাকে ভালবাসতে চায় ! কিছুদিনের মধ্যে তমশ্রী সেই চিরকুট হাতে পায় এবং পড়া শেষ করার পর, যাচ্ছে তাই বলে, ছিঁড়ে ফেলতে চায় । কিন্তু এক বন্ধুর কথা মতনই কোন ছেলে তাকে ভালবাসতে চায়, তা দেখতে চায় তমশ্রী । একদিন তুহিনকে খবরও পাঠায় তমশ্রী, দেখা করবার জন্য ।
শীতের বিকেল । স্কুল শেষে বান্ধবীর বাড়ি থেকে বেশ রকম সেজেছে তমশ্রী । তারপরই তুহিনের হঠাৎ উপস্থিতি । একটা নীল রঙের জামা পরে এসেছে তুহিন । তমশ্রীর গায়ে গেরুয়া রঙের স্কুল ড্রেস । রাস্তা দিয়ে তুহিনের সম্মন্ধে কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে আসছিল তমশ্রী, ওর বান্ধবী পম্পা, রশ্নি, আরও কয়েকজন । স্কুল থেকে অনেকটা দূরে, একটা রাস্তার বাঁকে দাঁড়ায় সকলে । তুহিনও দাঁড়ায় । একপাশে শাল, সেগুন গাছের বাগান । অন্য পাশে ধানের জমি । হাল্কা হাল্কা রোদ পড়ছে রাস্তার উপর । এই রাস্তা দিয়ে তেমন কোনও লোক যাওয়া আসা করে না । তমশ্রী ভাবে, এখানেই ওর সঙ্গে কথা বলার সেরা জায়গা । তুহিনকে দেখে তমশ্রী এত লজ্জা পেতে থাকে যে, কখনও চোখ তুলে তুহিনকে দেখেই না, মাথা নীচু করেই থাকে । বান্ধবীরা হাসাহাসি করে দুজনকে নিয়ে, কিছুটা দূর থেকে । তমশ্রী আর তুহিন একটা সেগুন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছে । অনেকক্ষণ পর, দুজনের নীরবতা ভেঙে তমশ্রী লজ্জা জোড়ানো কণ্ঠে বলে,
“তুমি আমাকে ভালবাসো ?”
তুহিনও ভীষণ লজ্জা বোধ করতে থাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে । মিথ্যে কথা বলতে ভয় করে কিন্তু ভালবাসার সত্যি কথাটা বলতেও যে তার থেকেও বেশি ভয় আর লজ্জা করে, তা যারা প্রথম কাউকে প্রেমের প্রস্তাব রেখেছে বা রেখেছিল তাঁরা জানে । তুহিন ম্লান হেসে, দুরুদুরু বুকে তমশ্রীর অনেকটা কাছে গিয়ে বলে,
“হ্যাঁ ।“
তমশ্রী হাসি আর লজ্জার আঁতড় মাখানো মুখে মৃদু স্বরে বলে,
“তাহলে বলো ।“
তুহিন বুঝতে পারে, তমশ্রী ঠিক কী শুনতে চায়ছে, কিন্তু বলতেই পারে না ও । মুখে এসেও যেন আটকে আটকে যাচ্ছে । তমশ্রীর অনেকবার বলো বলো বলো শব্দে শেষমেশ চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে দেয় তুহিন,
“আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি, অনেক ভালবাসি, অনেক ভালবাসি । আই লাভ ইউ । তুমি কি আমাকে ভালবাসবে ?”
তমশ্রী কিছু না ভেবেই ভীষণ আনন্দ নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ ।“
এ কথা শুনে তুহিন আনন্দে আত্মহারা, পৃথিবী থেকে কোথায় যেন হারিয়ে যায় । চোখে মুখে খুশির রোদ । তমশ্রীকে আদুরে গলায় বলে,
“কী হ্যাঁ ? পুরোটা বলো ।“
তমশ্রী মুখে হাত দিয়ে মাথাটা নীচু করেই বলে,
“আই লাভ ইউ টু ।“
সঙ্গে সঙ্গে বান্ধবীরা হাততালি দিয়ে ওঠে, আনন্দে এক প্রকার নাচতে থাকে । ভীষণ রকম হাসতে থাকে, শুভেচ্ছা বার্তা দেয় তমশ্রী আর তুহিনকে । এরপরই শুরু হয়ে যায় দুজনের বিশাল প্রেম । দিন যায়, রাত যায় । দুজন দুজনের প্রতি আরও গভীর ভালবাসা অনুভব করতে থাকে । ধীরে ধীরে ভালবাসা, দুজনের আকাশ ছেয়ে যায় । তুহিন কেমন যেন বোকা বোকা, পাগলাটে গোছের । ড্রেসিং সেন্স নেই, কথা বলার, চলার ধরণ ঠিক নেই । মাথায় বড় বড় চুল, দাঁড়ি-গোফ, একদম বিশ্রী মার্কা । তবু এই সবের মাঝে যে হৃদয়টা ছিল, যে মুখটি ছিল, তমশ্রী তাকেই ভালবেসেছে ।
এইভাবেই বছর খানেক পেরিয়ে যায় । বেশ শক্ত হয়ে ওঠে ওদের সম্পর্কের বাঁধন । এরমধ্যে অনেকে অনেক বাজে কথা বলেছে । কিন্তু ওদের ভালবাসা অনেকের বাজে কথার কোনও মূল্য রাখে না । এইভাবে বেশ সুখেই চলছিল দুটি জীবন । বহুবার বহু কারণে কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে । কিন্তু তুহিন চায় যেন কখনও ঝগড়া না হয় ওদের । যেন কখনও ভুল বোঝাবুঝি না থাকে ওদের মাঝে । তমশ্রীর কথা মতন তুহিন ভীষণ বদলে যেতে থাকে । অবশ্য তমশ্রী তুহিনকে বাধ্য করায় । চুল ছোট করে কাটায়, ভাল পোশাক পরতে বলে, কিনেও দেয় অনেক শার্ট । হাত ঘড়ি । এরমধ্যে তুহিনকে একদম মনের মতন করে সাজিয়ে তুলেছে তমশ্রী । এখন তুহিনকে দেখলেই বোঝা যায় প্রেম মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, কতটা রঙিন করে তুলতে পারে । তমশ্রী তুহিনকে ধীরে ধীরে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালবেসে ফেলতে থাকে । তুহিনও তাই । কিন্তু একটা ভাল চাকরি ছিল না তুহিনের । বাড়ি ঘরও তমশ্রীকে নিয়ে যাবার মতন ছিল না । আর্থিক দিকটাও খুব স্বচ্ছল ছিল না ।
এইভাবে আরও কয়েকটা মাস কেটে যায় । তুহিন সরকারি চাকরির জন্য বেশরকম পড়াশোনা শুরু করে, তমশ্রীর কথায় । তমশ্রী ওকে স্বপ্ন দেখায়, দুজনের একটি সুখের সংসার হবে, দুটো বাচ্চা থাকবে । তুহিন এইসব কিছু তাড়াতাড়ি করে ফেলতে চায় । কিন্তু একটা কাজ না হলে, এত টাকা কোথায় পাবে সে ? চেষ্টা করতে থাকে । দুজনই ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে । দিনের পর দিন এইভাবেই দুজনের সম্পর্ক আরও পূর্ণ হতে যাচ্ছিল ।
এরমধ্যে, তমশ্রীর বাড়িতে জেনে যায় তুহিনের সম্পর্কে । আর এইখানেই ঘটে যায় প্রথম দুঃখের ঘটনা । তমশ্রীরা উচ্চবিত্ত পরিবারের লোক । দিদি, জামাইবাবুদের অনেক টাকা পয়সা । তমশ্রীর বাবাও বড় ব্যবসাদার এবং জাতিগত দিক থেকে তুহিনদের অনেক উপরে । সেই দিক থেকে তুহিন খুবই ছোট মনে করে নিজেকে । ওদের মতন উচ্চতায় পৌঁছতে গেলে ওকে অনেক টাকা ইনকাম করে দেখাতে হবে । ওদের থেকে ভাল বাড়ি বানাতে হবে । তমশ্রীও এই কথা বলেছিল । যদিও তমশ্রী জাত, বর্ণে বিশ্বাস করে না । তবুও সে চায় বাবা মার মন ভাঙবে না, বিয়ের পর তাঁরা যদি জানতে পারে যে, তাঁদের মেয়ে ভাল ঘরে নেই তাহলে তাঁরা খুবই কষ্ট পাবে ।
যাইহোক, এইসব ঠিক হয়ে গিয়ে আরও এক বছর পেরিয়ে গেল । এরমধ্যে তুহিন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিও পেয়ে যায় । তমশ্রী খুব খুশি হয় । তুহিনেরও চিন্তা দূর হয় । না, এবার আস্তে আস্তে সবকিছু করে ফেলবে তুহিন । তারপরই তমশ্রীকে বিয়ে করতে পারবে । দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে । ভালবাসাববাসিও । তমশ্রীর বাড়ি থেকে অনেকে এই সম্পর্ক রাখতে বারণ করেছিল বটে কিন্তু তমশ্রী তুহিনকে কথা দিয়েছে, সে একমাত্র তার এবং তাকেই বিয়ে করবে । তুহিনও কথা দিয়েছে । ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় । এ নিয়ে তমশ্রী ভেবেছিল কিন্তু তুহিন যখন ওরই স্বামী হবে তখন বাঁধাটা যেন আলগা হয়ে গেছিল ।
|| ৫ ||
হঠাৎ একদিন তুহিন চাকরি হারায় । তমশ্রী ভেঙে পরে । তুহিনও । একরকম অবসাদে ভুগতে থাকে দুজনেই । কবে কীভাবে কী করবে বুঝতে পারে না কেউই । তুহিন ভাবে, “তমশ্রীর জীবন নষ্ট করে লাভ নেই, ভালই যদি বাসি তবে তমশ্রীই ভালই চাইব । কিন্তু ওর স্বপ্নগুলো পূরণ হবে কীভাবে, আলাদা বাড়ি, আলাদা সংসার, অনেক গহনা !” ভাবতে থাকে তুহিন ।
ওদের সম্পর্কটা চার বছর পূর্ণ হয়ে গেছে । কিন্তু এই চার বছরে তমশ্রীকে তেমন দামি কিছুই উপহার দিতে পারেনি তুহিন । সেই কথা মাঝে মাঝেই ইঙ্গিতে তমশ্রী বুঝিয়ে দেয় । অথচ তমশ্রী তুহিনের জন্য কী না করেছে । হঠাৎ তুহিনের প্রতি মনে মনে এক প্রকার সম্পর্কহীনতা অনুভব করে তমশ্রী । তুহিনও যেন বছর খানেক ধরে তমশ্রীকে অবহেলা করছে । ঠিক করে তুহিন যেন কথাই বলতে চায় না । কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা তো দূর, তমশ্রী কখনও বললেও, সটান না বলে দেয় তুহিন ।
আগের মতন তুহিন ভাল যে বাসে না সেটা তমশ্রী বেশ বুঝতে পারে । সারাদিন কাগজে কেবল লিখে যায় । তমশ্রী জানে ও ভাল লেখক, প্রথম প্রথম ওর কবিতার প্রতি অনেক ভাল লাগা ছিল । কিন্তু তুহিন যেন, তমশ্রীর থেকে বেশি আনন্দ পায় কবিতার কাছ থেকেই, তাই বোধহয় তমশ্রীকে বেশি সময় দিতে পারে না । তমশ্রীর রাগ হতে থাকে কবিতার প্রতি, কবিতাকে ঘৃণা করতে থাকে । কিন্তু তবুও অনেকবার বোঝায় তুহিনকে, এসব লিখে কিছু হবে না, কাজের খোঁজ করো, আমাকে একটু ভালবাসো । তুহিন, তমশ্রীকে ভালবাসার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না । এক দিকে কাজ নেই, বয়েসও পঁচিশ হল । অন্যদিকে তমশ্রীর প্রেসার, “ভাল কিছু করতে হবে, ভাল কিছু করতে হবে ।“
তমশ্রীর এইসব এক ঘেঁয়েমি কথা শুনতে শুনতে ভীষণই বিরক্ত হয়ে পড়ে তুহিন । একটুও ভাল কথা বলে না তমশ্রী । তুহিন বোঝে, ওর ভালর জন্যই বলে কিন্তু তুহিনও নিজের ভালটা বোঝে । তুহিনেরও স্বপ্ন আছে, ওকে ছাড়াও পরিবার আছে, তাঁদেরকেও তো দেখতে হবে । কিন্তু তমশ্রী এসব বোঝে না । তুহিনের প্রতি চিৎকার করতেই থাকে । তুহিন বাধ্য হয়, তমশ্রীর সঙ্গে কম কথা বলতে; কারণ, কথা বলতে গেলেই তমশ্রী এই একই কথা বলে । এখন তুহিন দেখাও করতে চায় না তেমন । কারণ, তমশ্রীর সঙ্গে দেখা করলে ও কেমন যেন ব্যবহার করে । তুহিন যেন অপদার্থ একজন, বোধ বুদ্ধিহীন, ছোট একজন মানুষ । তমশ্রী চিরদিন নিজেকে মহান ভেবে এসেছে । অবশ্য মহান ও বটে কিন্তু ভালবাসার মানুষের কাছে, নিজেকে বড় করার দাবি করতে নেই । ভালবাসার মানুষকে অসম্মান করতে নেই । যে সব ভালবাসার মধ্যে অনেক শ্রদ্ধা থাকে, অনেক ভক্তি থাকে, সেই সব ভালবাসা চিরকাল সবুজ ঘাসের মতন থাকে । কিন্তু তুহিন তমশ্রীকে বোঝায়, বহুবার বলেছে, ভাল ব্যবহার করতে, ভালভাবে কথা বলতে, কিন্তু তমশ্রী এইসব বোঝে না, শোনে না ।
তুহিন ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে । মনের অনেক কথা, দুঃখ, জমতে থাকে কাউকেই পায় না বলার মতন । তমশ্রীর কথা মতন একদিন সব বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গ ত্যাগ করে ফেলেছে তুহিন । তবে আজ পর্যন্ত তমশ্রী তুহিনের একটা কথাও কথা শোনে নি । আজও মনের কথা বলতে গেলে তমশ্রী শোনে না । তুহিন কষ্ট পায় । কিন্তু একটু মুখচাপা স্বভাবের বলেই, এইসব অভিযোগ আনতে পারে না তমশ্রীর প্রতি, তমশ্রীকে দোষারোপ করতে পারে না ওর মতো ।
লেখালেখির সঙ্গে জড়িত একটি মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব জমে যায় তুহিনের কিন্তু এ কেবল ভাবই, নিজের স্বার্থে । তুহিন মনে করে, সকল মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রাখা জরুরি একজন লেখকের । কথায় কথায় মনের সব কথাও সেই মেয়েটিকে বলে তুহিন । আর ওদের কথোপকথনের কথা তমশ্রী জানতে পেরে যায় এবং ভীষণই কষ্ট পায়, কান্না করে । তুহিনকে অনেক বকাবকি করে ।
এরপর বেশকিছুদিন তাদের যোগাযোগ ছিল না । যোগাযোগ হতেই একদিন তুহিন, অনেক দুঃখ প্রকাশ করে তমশ্রীকে বলেই দেয়,
“তম, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি, কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কের কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না । আমার ভরসায় থাকলে তোমার স্বপ্নগুলো পূরণ হবে না । আমি কোনও কাজ পাচ্ছি না । বাড়ি ঘর করতে পারব কী করে ? সরকারি চাকরি পাওয়ার আশা একদম করি না, রাজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ । এই অবস্থায় আমাদের আরও এগোলে বিপদ হবে ।“
তমশ্রী রেগে যায়, মন খারাপ হয়ে যায় ওর । বেশ রকম উত্তেজিত হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
“তুমি এতদিন তাহলে আমাকে মিথ্যে ভালবেসেছিলে ? আমার জন্যেও তুমি একটা কাজ খুঁজে নিতে পারছ না ? আমি ভাবতেই পারছি না, এতগুলো বছর ধরে আশ্বাস দিয়ে আজ তুমি আমাকে এই কথা বলছ ? এতদূর এগিয়ে এখন বলছ আরও এগোন বিপদ ? আমি কী চেয়েছি তোমার কাছে ? এতদিন তুমি আমাকে কী দিয়েছ ?”
তুহিন কেঁদে ফেলে ভেতরে ভেতরে, হতাশ হয়ে বলে,
কী করব বলো ? ভেবেছিলাম কিছু একটা করতে পারব কিন্তু এখন দেখছি কিছু করা অনেক কঠিন । বাস্তবটা অনেক কঠিন তম ! আমাদের স্বপ্ন দেখা উচিত হয়নি, ভালবাসা উচিত হয়নি…”
“তুমি কী চাও ? আমি তোমাকে ভুলে যায় ?”
তুহিন চুপ করে থাক, উত্তর দিতে পারে না । বোঝাতেও পারে না কিছু । ইচ্ছে হয় না তমশ্রীকে ছাড়তে, আবার ধরে রাখবার কোনও শক্তিও খুঁজে পায় না । তমশ্রী চোখের জল মুছে, ভেজা ভেজা গলায় বলে,
“ঠিক আছে আমি তোমাকে ভুলে যাচ্ছি, তুমি আমাকে মিথ্যে ভালবেসেছিলে তো ! ঠিক আছে । ভাল থেকো ।“
তমশ্রীর কান্নার জলে তুহিনের হৃদয় ভেসে যায় । কিন্তু তুহিনের গোপন কান্না তমশ্রী শুনতে পারে না । চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় তমশ্রী । তুহিন বাকরুদ্ধ, দাঁড়িয়ে থাকে একা । তুহিন আর তমশ্রী দুজনেই মনে হয়, “প্রেম একটি ঝড়, কখন যে কাকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে, তার নির্দিষ্ট কোনও মানচিত্র নেই । সবাই চিরদিন একই রকম থাকে না । একটা নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করার পর সবারই গন্তব্য পাল্টে যায় । ঠিক যেভাবে বিকেলের সিঁদুরে-আকাশ ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে ঢেকে যায়, ঠিক সেভাবেই মানুষ বদলে যায় । আর ঠিক যেভাবে দমকা বাতাসে গাছের শুকনো পাতা ঝরিয়ে দিয়ে যায়, আমাদের স্বপ্নও যেন, ঠিক সেই দমকা বাতাসে ঝরে গেল আজ ।“
সমাপ্ত