ছোটগল্প - সতী স্ত্রী
পর্ব ১
বিয়ের পর আমি কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটে স্ত্রী রানিকে নিয়ে ভাড়া আছি। আমার অফিস এখানেই, আমার নিজের বাড়ি থেকে এখানে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তবে রানির এখানে ভালো লাগছিলো না, ও কথায় কথায় বলে
- শহরে কত প্রবলেম ! খোলা আকাশ নেই,বাতাস নেই, বিকালে বাগানে ঘুরবো সে উপায় নেই। এভাবে কি বাঁচা যায়? আমি তাকে বোঝায়,
- রানি,কলকাতাতে তো হাজার হাজার মানুষ আছে, তারা বেঁচে নেই? কত সুযোগ সুবিধা বলো তো এখানে,আর আমরা তো শুধু শুধু এখানে পড়ে নেই,আমার চাকরি আছে। আর তুমি তো বলতে শহরে যারা থাকে তারা স্ট্যান্ডার্ড-স্মার্ট, তবে তুমি থাকতে চাইছো না কেন?
রানি মৌন মুখে তাকালো,দেখে মনে হচ্ছে রাগ করেছে আমার ওপর। কিন্তু কি করবো সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। কলকাতার মতো যায়গায় কি না সুন্দরী একটা মেয়ে থাকতে চাইছে না!
দিন দুয়েক পর আমরা আবার নিজের বাড়ি ফিরে এলাম। থাক কলকাতার সুবিধা! আমাকে প্রতিদিন জার্নি করেই অফিসে আসতে হবে। রানি বাড়িতে একাই থাকে। ওর যেখানে ভালো লাগে সেখানেই থাকতে হবে।
সন্ধ্যা বেলায় রানি ছাদে উঠে আমাকে বললো -
- দেখো, আকাশে কত তারা! ওফঃ কী সুন্দর!
রানি আনন্দে নাচতে লাগলো। দেখে আমিও খুশি হলাম, কিন্তু কষ্টটা আমার। আর ভালো লাগে না। ট্রামে বাসে যা ভিড় ।
রানি বাড়ির কাজ করতো না,তাই গোবিন্দ নামে একটা কাজের লোক রাখা ছিল। গোবিন্দর কাজ ছিল রান্না করা এবং বাসন মাজা। তাকে খবর দিতে তখনই চলে এলো, রাতের খাবার তৈরি করার জন্য।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি সবে, রানি আমাকে বললো, কাল আমার বন্ধুর জন্মদিন,দুপুরে ওর বাড়ি যেতে হবে,কিছু টাকা দাও তো।
আমি অত্যন্ত ক্ষুন্ন হলাম,রানি যেন একথা বলার অপেক্ষায় ছিল আমি কখন আসি। আমি বললাম,
- কখন নিমন্ত্রণ পেলে রানিদেবী?
রানি বললো,'সকালে।'
রানির অনেক বন্ধু-বান্ধবী আছে,সবাইকে আমি চিনি না,শুধু স্বপ্না নামে মেয়েটার সমন্ধে জানি। আমি রানিকে বললাম -
- ভালো,তো কোন্ বন্ধুর জান হঠাৎ? নাম কী তার?
-রানি কৌতুহলী হয়ে উল্টে আমাকে প্রশ্ন করলো,
- হঠাৎ বন্ধুর নাম শুনতে চাইছো কেন? এর আগে তো...
আমি তার কথায় বাধা দিয়ে বললাম
- এই দেখ,বন্ধুর বাড়ি যাবে নিমন্ত্রণ খেতে, এর আগেও বহুবার গেছো এসেছো,আজ যদি সেই বন্ধুর নামটা শুনতে চাই,তাও কি অপরাধ?
রানি মৃদু স্বরে বললো 'অরবিন্দ ঘোষ ।'
- তোমার কলেজের বন্ধু নাকি অরবিন্দ?
- হ্যাঁ, আমি আর স্বপ্না যাবো।
- ঠিক আছে ! কত টাকা দেবো?
রানি আমাকে বললো, 'পাঁচশো টাকা।' আমি তাকে টাকা দিয়ে বললাম,
- যা হোক, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, ড্রিকস্-ফ্রিকস্ কোরো না যেন। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে।
রানি কোনো জবাব দিল না। ও মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা, শপিং মল,গার্ডেন যায়। আমি সে বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ করি না। তাছাড়া রানি যেখানে যায় আমাকে বলে যায়,তার প্রতি আমার কোনো সন্দেহ নেই।
আমি রানিকে বিশ্বাস করি,সংসারে স্বামী কিংবা স্ত্রী যদি কেউ কাউকে সন্দেহ করে,তবে সংসারে অশান্তি দেখা দেয়। কাজেই আমি ওকে সন্দেহ করি না,যথেষ্ট বিশ্বাস করি আর ভালোবাসি। রানিও আমাকে খুব কম ভালোবাসে বলে মনে তো হয় না।
যাই হোক,সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখি রানি বাড়িতে নেই। সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসার কথা। আমি গোবিন্দকে জিগ্গেস করলাম
- গোবিন্দ,রানি থেকে বেরিয়েছে জানো?
গোবিন্দ মুখ চুলকে বললো -
- সকালে তো বৌদিমনিকে ডাকতে এসেছিলো ও পাড়ার মেয়েটা, তারপর... দাদা,আমি ফিরে গেছিলাম বাড়ি।
মনে মনে রাগ হল রানির ওপর। আমাকে বললো,দুপুরে বেরোবে,আর কিনা সকালেই চলে গেছে। নিশ্চয় ড্রিক করে পড়ে আছে। ওফঃ, রানিকে নিয়ে আর পারি না। আসুক আজ বাড়ি,দেখাচ্ছি ওর মজা।
রাত দশটা বেজে গেলো,রানি এখনো ফেরেনি। টেনশনে বশে থাকলাম চুপচাপ,কী হতে কী হবে তার নেই ঠিক। গোবিন্দ রাতের খাবার রেডি করে চলে গেলো। আমি রানির প্রতিক্ষায় রইলাম ।হ্যাঁ,হতেই পারে দেরি,হয়তো রাতে অরবিন্দ বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। একবার মনে হল,একটা ফোন করি ওকে,পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে কল করতেই খানের ওপর রানির মোবাইল বেজে উঠলো। একি,রানি মোবাইল নিয়ে যায়নি! নিশ্চয়ই ভুলে গেছে।
আশা ছেড়ে আমার মতো আমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে আমার ঘুম ভাঙলো। ভোর চারটে বাজে। আমি অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে থাকলাম। তখনি খেয়াল হল, আরে রানি তো রাত্রে আসেনি। মাথাটা চট করে গরম হয়ে গেলো। কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় দেখি রানি বাড়িতে ঢুকছে,পাঁচটা বাজে। আমি রাগে ফুলে উঠলাম। মনে হচ্ছিলো ওর গলা টিপে জিবটা টেনে ছিঁড়ে ফেলি । রানি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। আমি ক্ষিপ্ত ভাবে বললাম - রাত্রে তোমার ব্যবস্থা করছি।
রানি কোনো জবাব দিল না,আমি হন্তদন্ত হয়ে অফিস চলে এলাম।
সন্ধ্যা বেলা বাড়ি ফিরে রাগ অনেকটা কমে গেলো। কিন্তু তবুও রানিকে তীব্র মেজাজে ডাকলাম।
- রানি ! রানি!
ও আমার সামনে এসে দাঁড়াল,কিন্তু কোনো কথা বললো না। বুঝলাম ওই ভুলের শাস্তি ও পেতে চাই। বললাম,
- নিজেকে কী ভেবেছ হ্যাঁ?
ও হকচকিয়ে গেল, ওর সঙ্গে কোনোদিন কোনো সময় এমন মেজাজে কথা বলিনি,ও আমার দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল ।আমি কিছুটা নরম হয়ে বললাম,
- তুমি কাল সারারাত কোথায় ছিলে?
- কেন তুমি জানো না?
রানির উল্টা প্রশ্ন আমার মাথাটা পূর্বকার মতো গরম হয়ে উঠলো। দু'চোখ বিস্ফারিত ক'রে বললাম,
- কী! কী বলছো তুমি? কী বলছো?
আমি রাগে জ্বলে উঠলাম,ইচ্ছা হচ্ছিলো ওর গালে ঠাস্ করে একটা চড় কষিয়ে বলি,আমি তোমার স্বামী,আমার কথা মতো চলতে হবে,নিজের ইচ্ছে মতো নয়। কিন্তু তার মধ্যেই রানি বেশ মেজাজের সঙ্গে আমাকে বললো,
- তোমার জন্য কী আমি আমার পুরনো বন্ধুদের ভুলে যাবো?
আমি বললাম,
- হ্যাঁ যেতে হবে! হ্যাঁ তাই যেতে হবে। তুমি একজনের স্ত্রী,ঠিক আছে? বন্ধুর বাড়ি রাত কাটানো যাবে না।
রানি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে কটু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
- তুমি আমাকে কী বলতে চাচ্ছ ?
এই ঘটলো মহা বিপদ.....
রানি ভাবলো আমি ওকে কোনো প্রকার সন্দেহ করি। কিন্তু আমার অজান্তে রানি কী করে না করে, আমি তা জানি না। তাছাড়া অবিবাহিত বন্ধুদেরকেই বা কী করে বিশ্বাস করি। আমি জানি যে এখনকার ছেলেপিলে সুযোগ পেলেই লাভ ওঠায়। যদি কাল রানির কিছু হয়ে থাকে, সেটা রানির ইচ্ছা অনিচ্ছা, তাছাড়া রানি ড্রিঙ্ক করে, কাল নিশ্চয় করেছিলো জন্মদিন বলে কথা। আর ওই স্বপ্না, জেনে শুনেও একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে মিশতে দিই, এতে আমারি কপাল দোষ। আমি শান্ত হয়ে রানিকে বোঝাতে লাগলাম।
- রানি, দেখো যদি তোমার অজান্তে কাল তোমার কিছু হয়ে যেতো, তখন? তুমি তো ফোন নিয়ে যাও নি, আমি কী করতাম?
রানি বললো,
- আমার অজান্তে এমন কিছুই হবে না যেটা আমি চাই না।
- দেখো তুমি কী চাও না চাও সেটা আমি জানি। আচ্ছা,তুমি কি কাল ড্রিঙ্ক করেছিলে?
- হোয়াট? কী বলতে চাও তুমি?
- আমি বলছি, তুমি কি কাল মদ-টদ খেয়েছিলে?
- দেখো, যদি তোমার কোনো রকম সন্দেহ হয়,তবে স্বপ্নাকে জিঘাংসা করতে পারো। আর অরবিন্দ এর সাথে তুমি কথা বলবে? কল করবো ওকে?
- না-না, তার দরকার নেই, আমি তোমাকে যথা বিশ্বাস করি। কিন্তু কাল রাতে তুমি বাড়ি ফিরলে না কেনো?
- সেটা তুমি প্রথমেই ভালো করে জিগ্যেস করতে পারতে?
- আচ্ছা বাবা,আমার ভুল হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা চাইছি, পায়ে পড়তে হবে ? বলো ...
রানি আমাকে বললো যে, কাল রাত্রে নাকি খাওয়া-দাওয়া করতে দেরি হয়ে গেছিলো, তাই বন্ধুরা বারণ করেছিলো এত রাতে একা বাড়ি ফিরতে।
আমি আশ্বস্ত হলাম বটে, কিন্তু মনের মধ্যে একটা সন্দেহের দানা রয়েই গেলো । আমি ভাবতে লাগলাম রানিকে নিয়ে ও যদি আমাকে ফাঁকি দিয়ে...
দু'চার দিন বাদি আমার এক বন্ধু অরুন মিত্রের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে প্রশান্ত পাল নামে রানির আরেক বন্ধু স্বপ্নার সাথে প্রেম করে। আমার বন্ধু অরুন মিত্রের স্ত্রী স্বপ্না। অরুনকে ছেড়ে চলে আসে। কিন্তু অরুন স্বপ্নাকে এখনো ভালোবাসা, যদিও জানে সবকিছুই। স্বপ্না এবং রানিকে অরবিন্দ এর বাড়ি আসতে দেখেছে অরুন।
আমি অফিস যাচ্ছিলাম হঠাৎ পিছন থেকে ডাক,
- হ্যালো অফিসার?
পিছন ঘুরে দেখি অরুন মিত্র। আমি দাঁড়ালাম ওকে জিগ্গাসা করলাম,
- কিছু বলবি নাকি?
অরুন বললো,
- ব্যস্ত আছিস, রাত্রে বাড়িতে আসিস, কথা আছে।
রাত্রে অরুনের বাড়ি গিয়ে শুনলাম এত সমস্ত কথা। অরুন তার পর আর বিবাহ করেনি । বেশ করে আড্ডা মেরে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম।
রাতে শুয়ে ভাবতে থাকলাম যে, আমার জীবনে যে ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনা অরুনের জীবনে বছর খানেক আগে ঘটে গেছে। স্বপ্নার সঙ্গে রানি যদি মেশে তাহলে আমার জীবনের পরিনতিও অরুনের মত হবে। কাজেই সিদ্ধান্ত নিলাম, যে খেলা চলছে সেটাকে বন্ধ করতে হবে, কিন্তু কীভাবে কী করব ভেবে পেলাম না।
একবার ভাবলাম পুরোনো জিনিস পত্র নিয়ে অরুনের মত আবার ডাক্তার খানাটা খুলে বসি, তাতে রানিকে নজরে রাখা যাবে। আবার ভাবলাম রানিকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। আবার মনে হল,রানিকে স্বপ্না এবং ওর বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না দিলেই তো সমস্যার সমাধান।
কিন্তু সমস্যার সমাধানের অন্য ভাবনাকে কাজে লাগালাম দিন দুয়েক পর।
রবিবার, আমি বারান্দায় বসে পেপার পড়ছি, রানি ঘরে। এমন সময় স্বপ্নাকে আসতে দেখলাম,স্বপ্নার বাড়িতে প্রবেশ এবং চলাফেরা দেখে বুঝলাম এ বাড়িতে প্রায়ই আসে। না জানি অরবিন্দও আসে কিনা? স্বপ্নার সঙ্গে আমি তেমন ভাবে কোনোদিন কথা বলিনি।, কিন্তু লাঠি যখন হাতের কাছে, তখন সাপ কেন হাত দিয়ে তাড়াবো ? এই ভেবে স্বপ্নাকে ডেকে রসের কথা বলতে লাগলাম কতকটা এই রকম -
- বাঃ! তোমাকে তো হেবি দেখাচ্ছে, কতদিন বাদে তোমায় এত কাছ থেকে দেখছি!
- স্বপ্না প্রথমত লজ্জা পেলেও প্রত্যুত্তর দিল চুপি চুপি
- আরো কাছ থেকে দেখলে আরো ভালো লাগবে,বুঝলে ?
আমি ওর কথা শুনে হতবাক। এমন ধরনের ভাষা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ভাবলাম, যাক, কাজ তবে হবে! ও ততক্ষণে উঠানে চলে গেছে । আমি ওকে ডাকলাম,
- শোনো, শোনো, কোথায় চলে যাচ্ছ?
- বাড়ি যাচ্ছি তো!
স্বপ্না নিরুত্তর ভাবে চলে গেলো।
যাই হোক,আমি আমার কাছে মন দিলাম তীব্র ভাবে,রানিকে প্রবলভাবে সন্দেহ হতে লাগলো। মনে হয়, রানি সত্যি অরবিন্দর সঙ্গে গোপনে প্রেম করে। কিন্তু প্রমাণ পাচ্ছি না, হাতে নাতে একদিন ধরতে পারলে হয়। রানিকে ভিটেছাড়া তো করবই আর অরবিন্দকেও দেখাবো মজা। চুরি করে ফল ওকে খাওয়াচ্ছি, দাঁড়াও চাঁদ।
দু'চার দিন বাদে আমি অরুনের বাড়ি গেছি, আমার সমস্ত সমস্যার কথা ওকে বললাম। ও বললো,
- ভাই, এত কিছুর কী দরকার আছে! রানিকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিস না, ব্যস।
- তাহলে তো হয়েই যেতো।
- মানে?
- আমি কি সারাদিন বাড়ি থাকি? রানিকে বলে যাব কোথাও যাওয়া তোমার হবে না,তবে রানি কোথাও যাবে না, তোর বিশ্বাস? শোন্ ভাই, এতদিন রানিকে করতাম,কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর না।
অরুন ভেবে চিন্তে বললো,
- তুই বলছিলিস না উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ওদেরকে দোষ দেওয়া যাচ্ছে না,তবে একটাই ভালো উপায় আছে,তুই যে প্লান করেছিস সেটাই বেটার।
আমি ওকে বললাম,
- কিন্তু সে পথে কি ভয় নেই? যদি কোনো ভাবে রানি জানতে পারে যে স্বপ্নার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, তাহলে পুরো উল্টো কেস হয়ে যাবে। একেবারে খাল কেটে কুমির...
- আচ্ছা, একটা কাজ করেছিস কি?
আমি বললাম কী? ও বললো,
- কল ডাইভার্ড। যদি তুই রানির সমস্ত ইনকামিং কল তোর ফোনে ডাইভার্ড করিস, তবে রানিকে ফোনে আর কেও পাবে না, আর গোবিন্দকে সারাদিন বাড়িতে থাকতে বল্, আর আমি তো বসে থাকি অরবিন্দ এর বাড়ির সামনে। রানিকে আসতে দেখলে তোকে জানাবো।
- আমি অরুনের কথায় ভাবতে লাগলাম,অরুন আবার বললো,
- আঃ ! পেয়ে গেছি রাস্তা।
আমি বললাম, কী?
- কলকাতা চলে যা রানিকে নিয়ে, ফ্যাটে ভাড়া করে থাকবি।
অরুনের কথায় আমি বিপুল হাসলাম, কিন্তু পরক্ষণেই থামতে হল। নিজের কথা ভেবে লজ্জা পেলাম, আমি কিনা স্ত্রীকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। অরুন বললো,
- হাসছিস কেন?
- সে কাজও করেছিলাম ভাই কিন্তু, এখন বুঝতে পারছি যে রানি সেখানে থাকতে চাইছিলো না কেন। আর এখনি শিওর হলাম যে রানি অরবিন্দ কিবা অন্য কারো সাথে প্রেম করছে।
পর্ব ৩
এর মধ্যে স্বপ্নাকে পটিয়ে ফেললাম, কিন্তু রানি আর অরবিন্দর সম্বন্ধে একটা কথাও ওর মুখ থেকে বার করতে পারলাম না ।
একদিন স্বপ্নাকে নিয়ে গোপনে সিনেমাও দেখতে গেলাম, সম্পর্ক গভীরে নিয়ে যাবার জন্য । এবং তাকে বলেও দিলাম যে রানি যেন কিছুমাত্র সন্দেহ না করতে পারে ।
আমি বুঝতে পারছি স্বপ্না কেমন জালে জড়াচ্ছে, একদিকে অরুণকে কষ্ট দিয়ে প্রশান্তর সঙ্গে প্রেম, আর একদিকে প্রশান্তকে ফাঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে । আবার রানির প্রেম গোপন রাখার শপথ ।
যাই হোক, এ ধরনের মেয়েদের অবস্থা কী হবে সেটা ভগবানই জানেন ।
স্বপ্নার সঙ্গে বেশ জমে উঠলো প্রেমের খেলা, কিন্তু এসবই ক্ষণকালের জন্য অভিনয় মাত্র ।
একদিন রাত্রে রানি আমাকে বলছে,
- জানো, আমার সেই বন্ধুটা পালিয়েছে ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
- কোথায় পালিয়েছে, কেন কেও কি তাকে তাড়া করেছিলো নাকি ? নাম কী তার ?
রানি বললো,
আরে প্রশান্ত, প্রশান্ত । যে স্বপ্নার সাথে প্রেম করতো ।
- বাহ্, তা তো ভালোই হয়েছে । শীতের দিন, নতুন বিয়ে । এবার হয়তো অরবিন্দও পালাবে ।
পরক্ষণেই মনে হল প্রশান্ত স্বপ্নাকে নিয়ে পালিয়েছে, তাহলে আমি ? মাথায় বাজ পড়লো আমার । রানিকে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম,
- স্বপ্না কি প্রশান্তর সঙ্গে পালিয়েছে ?
- আরে বাবা স্বপ্না পালায়নি, প্রশান্ত অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে পালিয়েছে ।
কথাটা শুনে আমার ধরে প্রাণ এলো । প্ল্যান তবে ঠিক লাইনে লাইনে যাচ্ছে । কাজটা যে কতটা সোজা হয়ে এলো তা কী করে বলবো । রানিকে বললাম,
- অরবিন্দ কার সাথে প্রেম করে ?
- জানি না ।
- প্রশান্ত যে অন্য আরেক জনের সাথে প্রেম করতো তুমি জানতে ?
- না তো !
- স্বপ্না জানে যে ওর বয়ফ্রেন্ড পালিয়ে বিয়ে করেছে ?
- না, অরবিন্দ আমাকে ফোনে জানালো । ভাবছি স্বপ্নাকে কী বলবো ।
আমি আনন্দে নাচতে থাকলাম একপ্রকার, পেটের ভিতর অট্টহাস্য করে উঠছে আমার আত্মা । এই সুযোগ রানিকে.... ভাবলাম এই সময় রানি যদি অরবিন্দর সাথে কোথাও যেত, তবে কি লাভটাই না হত । ছ্যা ছ্যা সুযোগ এসেও হাতছাড়া ।
অরবিন্দর বাড়ির সামনে আমার বন্ধু অরুণের ডাক্তারখানা, ওকে বলেছিলাম রানি যদি অরবিন্দর বাড়ি আসে, তবে আমাকে জানাতে । আর ওর কথামতো গোবিন্দকে সারাদিনের চাকরিতে নিযুক্ত করেছিলাম, আর গোবিন্দকে বলে দিয়েছিলাম রানিকে নজর রাখতে । যাইহোক রানিকে বললাম স্বপ্নাকে জানিয়ে দিতে, আজ বাদে কাল ও তো জেনেই যাবে, তার চেয়ে বেচারি সঙ্গে সঙ্গেই জেনে যাক ।
রানি আমাকে বললো,
- জানতে পারবে না, আমি আর অরবিন্দ যদি না বলি তাহলে ও টেরও পাবে না । কারণ প্রশান্ত ওর মোবাইল নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলেছে । স্বপ্নার কাছে ওর নাম্বার নেই ।
আমি চমৎকৃত হলাম এবং বললাম,
- বাবা ! এত গোপনে প্রেম ? তোমাদের তো তুলনা হয় না ।
আমার কথায় রানি অবাক হল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
- আমরা মানে ?
আমি বললাম,
- তোমরা মানে তোমাদের বন্ধুরা । এই যে প্রশান্ত স্বপ্নার সঙ্গে প্রেম করতো, কেও জানে না....
রানি একথা এড়িয়ে আমাকে বলল,
- কী করবো বলো না ।
আমি বললাম,
- তুমি কী করবে ? আমি জানি নাকি এসব !
রানি চুপ করে গেলো । আমি রানিকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের মনেই বললাম, "স্বপ্না যে কী কান্না করবে, যদি শোনে একথা । সত্যি প্রশান্তর তুলনা হয় না । কি কাজটাই না তুমি করলে প্রশান্ত ! ডুবে ডুবে জল খাওয়া ? কত জনের সঙ্গে সম্পর্ক, কাল নিশ্চয় ধরা পড়াতে এলাকার লোকজন ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছে ।"
- রানি আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
- আহ্ঃ ! ছাড়ো তো ন্যায়দর্শন । সমস্যায় পড়ে গেলাম আমি, আর উনি ডায়ালগ ঝাড়ছেন । কী করব বলো -
তখন আমি প্ল্যান-ফ্ল্যান করে রানিকে বললাম,
- অরবিন্দকে বাড়িতে ডাকো, ও হয়তো সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারবে ।
- রানি বললো,
- ফোনে ব্যালেন্স নেই । তোমারটা দাও তো ।
আমি প্ল্যান করে ওকে বললাম,
- আমারো তো ব্যালেন্স নেই ।
জানি না রানিও প্ল্যান করে আমাকে ব্যালেন্স না থাকার কথা বললো কি ! হয়তো দেখছে যদি অরবিন্দকে ডাকতে ওর বাড়িতে যেতে বলে ।
যাই হোক, আমি রানিকে বললাম,
- ঠিক আছে, তুমি অরবিন্দকে ডেকে আনো, যাবার পথে স্বপ্নাকেও পাঠিয়ে দিও । আমি তো বাড়িতেই আছি, সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি । কিন্তু কী সমস্যার সমাধান করবো তা তো আমি ভালোই জানি । ভাবলাম, সুযোগ যখন আমিও পেলাম, কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকা ।
রানি সেজেগুজে চলে গেল অরবিন্দর বাড়ি....
পর্ব ৪
যাবার পথে স্বপ্নাকে ডেকে দেবার কথা আছে । যদি সত্যি কোনো প্ল্যান রানিও করে, তবে অবশ্যই স্বপ্নাকে পাঠিয়ে দেবে । আমি জানি অরবিন্দ আসবে না, তাকে রাজি করিয়ে আনতে এক-দেড় ঘন্টার ব্যাপার । তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি আসবে না সেটা বুঝতেই পেরেছি এত দিনে ।
ঘরে টিভি চালিয়ে বসলাম । প্রতীক্ষায় থাকলাম স্বপ্নার, প্রেম আজকে জমে যাবে । পকেটে ফোনটা বেজে উঠলো, অরুণের কল ।
- হ্যালো । হ্যাঁ বল্ -
ফোনের ভিতর থেকে শব্দ এলো - রানি অরবিন্দর বাড়ি আসলো । তুই বাড়িতে নেই ?
আমি বললাম,
- হ্যাঁ ভাই ।
- তবে ?
- প্ল্যান করে ওকে পাঠিয়েছি । তোকে পরে বলবখনি ।
এর মধ্যে স্বপ্না এসে ঘরে ঢুকলো, - আসতে পারি ?
- এসেই তো পড়েছো !
মনে মনে একটা অজানা রাগ এসে বলে গেল - আহ্ঃ পেয়ে গেছি ! এবার আমার খেলাও শুরু রানি, চালাক আমিও কম নয় ।
যাই হোক, ঘটনা যে এভাবে এগিয়ে আসবে তা আমি ভাবতে পারিনি । এ সময় জীবনের প্রথমবার ভগবান যে আমার সহায় হয়ছেন, তা বেশ বুঝতে পারছি । আমি স্বপ্নার সঙ্গে গভীর প্রেম খেলায় ডুবে গেলাম ।
রানি তোমার ব্যবস্থা করছি, খেলো প্রেম প্রেম, তোমার সময় ফুরিয়ে এসেছে । এবার আমার পালা, তুমি কত বড় খিলাড়ি হয়ে গেছো দেখছি । আমাকে ফাঁকি দিয়ে পরকে যৌবন দান ? শেষে তুমি একুলও হারাবে আর ওকুলও । তোমার মত বেশ্যা স্ত্রী-কে পুষতে আমার বয়ে গেছে । (তোমার স্থান যেন রাস্তার অলিতে-গলিতেই হয়।)
স্বপ্নাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
- তুমি প্রশান্তকে চেনো ?
স্বপ্না বললো,
- হ্যাঁ, কেন বলো তো ?
- শুধু চেনো, নাকি আরো কিছু ?
- তুমি তো সব জানো, কিন্তু কী হয়েছে ওর ?
আমি বললাম,
- কিছুই হয়নি, শুনলাম ও নাকি বিয়ে করেছে ? তুমি কি ওকে ছেড়ে দিয়েছো ?
স্বপ্না জবাব দিলোনা । আমার কথা শুনে ও অবাক ।
- সত্যি নাকি ?
আমি বললাম,
- হ্যাঁ, রানি আমাকে বলেছিলো, তোমাকে একথা জানানোর জন্য ডাকা হয়েছে ।
- রানি কোথায় গেলো ?
- অরবিন্দর কাছে । প্রেম করতে ।
- তুমি সবকিছু জানো দেখছি ।
আমি বললাম, জানতাম না, জানতে পেরে গেছি, সেদিনের পর থেকে । আর তোমার সম্পর্কে তো শুনেছিই অরুণের কাছে । তুমি তো জানো, ও আমার ভালো বন্ধু ।
কথা বলতে বলতে স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম দেখলাম ওর চোখে জল ।
চোখের জল গোপন করে আমাকে বললো,
- যার জন্য অমন ভালোমানুষটাকে ব্যাথা দিয়ে তাকে ছেড়ে চলে আসলাম, আজ সে-ই কিনা অন্য মেয়ের হাত ধরে চলে গেলো আমাকে ফেলে ! হায় রে, ভেবেছিলাম প্রশান্তকে বিয়ে করে সুখের সংসার গড়বো, কিন্তু প্রশান্ত যে আমার সঙ্গে প্রেমের নামে ভালোবাসার খেলা করতো, জানতে পারিনি ।
আমি স্বপ্নাকে আশ্বস্থ করতে চেয়ে বললাম,
- দুঃখ কোরো না স্বপ্না, আমি জানি কে কেমন মানুষ । অরুণের মতো মানুষ হয় না, তুমি ওকে ছেড়ে ভুল করেছো । তোমাদের শুনেছিলাম ভালোবাসা করে বিয়ে হয়েছিলো ?
- হ্যাঁ ।
- অরুণ তোমাকে আজো ভালোবাসে জানো, ও বিয়ে করেনি তোমার আশায়, যদি তুমি একদিন ভুল বুঝে ফিরে আসো, এই ভেবে ।
স্বপ্না আমাকে যা বললো, তাতে আমার মন বিষিয়ে গেলো । রানিকে কী কুক্ষণে দেখে যে ভালোলেগে গেছিলো ! এখন বুঝতে পারছি, সুন্দরী মেয়েদের কী গুণ । স্বপ্না আমাকে বললো,
- রানি তোমাকে কোনোদিন ভালোই বাসেনি । ও অরবিন্দর সঙ্গে.....
আমি ওর কথায় বাঁধা দিয়ে বললাম,
আমি জানি স্বপ্না, আমি সব জানি । কিন্তু তুমি তো এমন ছিলে না ?
স্বপ্না দীর্ঘশ্বাস ফেললো । কিছুক্ষণ বাদে আমাকে বললো,
- আমার সর্বনাশ করেছে রানি, আজকে আমি কত সুখে থাকতাম অরুণের সঙ্গে । সত্যি সে সময় রানির পাল্লায় পড়ে আমি কেমন যেন হয়ে পড়েছিলাম । তারপর কিছুই বুঝতে পারিনি, আজ আমিও ওর মতো হয়ে গেছি, ছিঃ ! আমি ভাবতে পারছি না ।
আমি বললাম,
- স্বপ্না আমি যে কী যন্ত্রণায় ভুগছি, তা তোমাকে বলে বোঝানোর নয় । কিন্তু তুমি আমাকে কেন জানাওনি যে, রানি ও পথেরই পথিক ?
স্বপ্না নীরবে বসেই থাকলো । আমার কিছু ভালো লাগছে না, স্বপ্না তুমি আমাকে কেন জানাওনি রানি এতটা বাজে মেয়ে, কেন আমাকে বলোনি ও আমাকে ভালোবাসে না । হে ভগবান, এখন আমি কী করবো ? কী যন্ত্রণা, কী অসহায়....
আমি ভেঙে পড়া মাটির মূর্তির মত মূর্চ্ছা গেলাম, মাথার যন্ত্রণা, বুকের যন্ত্রণা, হে ভগবান, এ কেমন সাজা তোমার, যত দোষ কী আমি করেছি ? হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠলো প্রবল, রানি, রানি ! চোখ দিয়ে দু'বিন্দু রক্ত ঝরে পড়লো ।
রানি যদি আমার সামনে থাকতো, ওকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলতাম । মাথা খারাপ হয়ে গেলো আমার, আমি ঘরের শোকেস, টিভি ভেঙে ফেলতে লাগলাম পাগলের মতো, কাঁচের টুকরো আমার হাতে ফুটে রক্তের স্রোত বইতে থাকলো । ক্রমাগত রানির সেই মুখ ভেসে উঠছে, স্বপ্না আমাকে থামানোর চেষ্ঠা করছে । কিন্তু আমি উন্মাদ, খুন করে ফেলবো সবাইকে ।
হায় ! কাকে ভালোবেসেছি আমি ? কাকে নিয়ে সংসার করতে বসেছি ? কাকে, ভগবান কাকে ?
রানি এখন অরবিন্দর সঙ্গে প্রেম-খেলায় মগ্ন, আবার ভেসে উঠছে সে ছবি । ওফ্ঃ, কী যন্ত্রণা !
না ! আমি দেখতে চাই না ! দেখতে চাই না রানির মুখ । বারবার বারবার চোখে ভেসে উঠছে তবু । এত অপমান - এত যন্ত্রণা হায় !
ধীরে ধীরে ড্রয়ারটা খুললাম, সেখানে একটা বিষের শিশি রাখা ছিলো । আমি পাগলের মতো স্বপ্নাকে বললাম চলে যেতে । স্বপ্না দৌড়ে পালালো ।
সমাপ্ত