ছোটগল্প - ভেদাভেদ
বিয়ের সানাই বেজে ওঠে । হিন্দু মতেই আজ বিয়ে সেলিনার । বরযাত্রী আসতেই ঘিরে ধরে পাড়াপ্রতিবেশী । না কোনো গোলমাল নয়, বরকে স্বাগত জানিয়ে ফুল ছুঁড়ে দিতে । আগে থেকেই পাড়া গ্রাম জেনে গেছে, সমন্ধ করেই বিয়ে । রাকেশের ইচ্ছে ছিল ধুমধাম করে বিয়ে করার আর হলও তাই । কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসে সেলিনার মুখ দেখতে চায়নি রাকেশ । সেলিনা যে খারাপ দেখতে তা নয় । গায়ের রং গোলাপী পদ্মের মতো, এক পিঠ চুল, কালো কালো দুটি চোখ । এরকম চোখের দিকে তাকিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় । পরনে লাল বেনারসী শাড়ি, হাতে এক গোছা চুরি, মেহেন্দি, এক অপ্সরা যেন গুটি গুটি পায়ে রাকেশের সামনে এসে বসলো । মণ্ডপ ঘিরে রয়েছে লোক জন, আত্মীয়েরা । এ রাতে যেন খুশিতে ঝরে পড়ছে আকাশের সব তারা । জ্যোৎস্না ঝকঝক করছে । এমন খুশির দিনে কে জানে পারমিতা কোথায় । হয়তো বিছানার এক কোণে শুয়ে তারাদের খসে পড়া দেখছে, হয়তো কোনো বন্ধুর সঙ্গে চ্যাটিং করতে ব্যস্ত ।
যা হোক, তাতে রাকেশের কিচ্ছু যায় আসে না । বাকিটা জীবন শুধু সেলিনাকে জাপ্টে ধরে বাঁচতে চায় সে । কিন্তু হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে । সমাজ মানবে তো ? বাবা মা কীভাবে মানবে ? হাজার প্রশ্নকে কাঁধে নিয়েও রাকেশ তার স্বপ্ন পূরণ করেই ফেলে এবং যোগ্য জবাবও দিয়ে দেয় পারমিতাকে ।
পারমিতা রাকেশের পুরনো প্রেমিকা । রাকেশের কলেজ জীবনের সঙ্গি । হঠাৎ একদিন বাসস্টপে পারমিতাকে দেখেই মনে মনে তাকে নিয়ে ভাবনার জাল বুনতে থাকে রাকেশ । কিন্তু রাকেশ জানে তার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া মানে জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ । পারমিতার জামাইবাবু এলাকার মস্তান । হাজার একটা খুনের জন্য বিখ্যাত । বিশাল বাড়ি গাড়ির মালিক সে । চব্বিশ ঘন্টা একদল ডাঙ্গাবাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় । সে যদি জানতে পারে কোনো ছেলে তাকে ভালবাসার প্রস্তাব রেখেছে তো তার মুন্ডু কেটে জলে ভাসিয়ে দেবে । কিন্তু প্রেম কোনো বাঁধা মানে না আর তাই একদিন কলেজ গেটে বুকে সাহসের বাতাস নিয়ে, পারমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাকেশ । একদল বান্ধবীকে পাশে রেখে পারমিতা এগিয়ে আসে কথা বলার জন্য । রাকেশকে দেখে প্রথমটা বুঝতে পারেনি পারমিতা যে সে প্রেম প্রস্তাব করবে । পরনে ঢিলেঢালা পুরনো জামা, জিন্সের প্যান্ট, মাথায় এক গোছা চুল । যা হোক, কাঁপতে কাঁপতেই মনের কথাগুলো বলে দেয় রাকেশ । পারমিতা উত্তর না করেই বাড়ি চলে যায় । কিছুদিন রাকেশ মুখ লুকিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে লাগল । তার ভয় পারমিতা নিশ্চই ওর জামাইবাবুকে ব্যাপারটা জানিয়েছে । এবার নিশ্চই রাকেশের সাহসের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য রাস্তায় লোক ঘুরছে ।
কিন্তু তেমনটা হল না । পারমিতা রাকেশকে কলেজ গেটেই দেখা করতে বলেছে । পারমিতার কোনো এক বন্ধু এসে একথা জানিয়ে গেলো রাকেশকে । রাকেশের মনে তো লাড্ডু ফুটছে । ভয়ভীতি কোথায় যেন লোপাট হয়ে গেলো খবরটা শোনামাত্র । বেশ করে চুল আঁচড়ে, নতুন জামা পড়ে পারমিতার সঙ্গে দেখা করতে গেলো রাকেশ ।
রাকেশের বয়েস চব্বিশ কী পঁচিশ হবে, পারমিতার কুড়ি কিংবা একুশ । এ বয়সে কারোর প্রেমে পড়া কঠিন নয় । কিন্তু কোথায় পারমিতার পরিবার আর কোথায় রাকেশের । পারমিতার পরিবার কোনোদিন এই সম্পর্ক মানবে না জেনেও পারমিতা রাকেশকে জানিয়ে দেয়,
- আমরা সম্পর্কে আসতে পারি কিন্তু তোমাকে ভালো চাকরি করতে হবে । পরিবারের চাল-চলন বদলাতে হবে ।
রাকেশ ভাবে এ কী আর বড় শর্ত এ তো সময়ে এমনিই বদলে যাবে । পারমিতাকে কথা দিয়ে দেয় রাকেশ । শুরু হয়ে যায় প্রেম । রাকেশ লক্ষপতি যে পারমিতার মতো এত উঁচু ঘরের মেয়েকে পটাতে তার দু মিনিটও সময় লাগল না । তারপর মেয়ে যে খুব খারাপ দেখতে তাও না । ফর্সা, সামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্চতা, পড়াশোনা করছে । রাকেশ পারমিতাকে পেয়ে, তার বয়েসের কথা, পরিবারের কথা ভুলে গেলো । ভুলে গেলো তার বাবা একজন চাষী সারাদিন মাঠে কাজ করে । রাকেশ এও ভুলে গেলো সে নীচু জাতির ছেলে, তার পারমিতাদের মতো ঘর নেই, কাজ নেই । কিন্তু রাকেশ যে খুব বোকা তা নয় । সম্পর্ক শুরু হতে না হতেই ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা শুরু, চাষ আবাদের সব কাজই করতে শুরু করে দেয়, পয়সা জমাতে থাকে । একদিন সে ভাল বাড়ি বানাবে, পারমিতাকে বিয়ে করবে, ওদের একটা সুন্দর সন্তান হবে ।
দেখতে দেখতে দুই এক বছর পার হয়ে যায় । পারমিতার সঙ্গে রাকেশের ভালবাসা গভীর হতে থাকে । রাকেশ বদলাতে শুরু করে । পারমিতার কথামতো পোশাক কেনা, খাওয়া দাওয়া সব বদলে যায় । দুজনের এত প্রেম দেখে কেউ কেউ বলে, এত প্রেম ভাল নয় । কিন্তু কে শোনে কার কথা, পারমিতার ভরা যৌবনে রাকেশ ছেয়ে যেতে শুরু করে । কিন্তু এই এক বছরে প্রেম ছাড়া রাকেশ কিছুই করতে পারেনি । পড়াশোনা করেও চাকরিটা জোটেনি । ছোটোখাটো কোনো কাজও জোগাড় হয়নি । ঠিক সময় হয়ে যাবে যাবে করেও হচ্ছে না ।
এইভাবেই প্রেমে অপ্রেমে আরও দুটো বছর পার হয়ে যায় । এরমধ্যে, বেশ কিছুবার নানান কারণে ওদের মধ্যে বিচ্ছেদ জেঁকে বসে । কিন্তু পারমিতার পাগলামী আর রাকেশের ভালবাসা দুজনকে আলাদা করেনি । বেশ কিছুবার শারীরিক সম্পর্কেই লিপ্ত হয় দুজনে । পারমিতা প্রথমদিকে না চাইলেও শেষ দিকে একপ্রকার নেশাই পরিণত হয়ে গেছিলো । এরকমই একদিন রাতে পারমিতার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে রাকেশ । আজ বাড়িতে কেউ থাকবে না, চুটিয়ে প্রেম হবে এই কথা বলে রাকেশকে ডাকে পারমিতা । উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার রাত, বসন্তের শুরু । আলো আঁধারে মেতে ওঠে দুজনের দীর্ঘকালীন সহবাসে । দুজনে শপথ নেয় কেউ কাউকে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না । পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
- কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো ?
রাকেশ পারমিতার কপালে একটা চুম্বন করে বলে,
- এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার বউ । বলো, বউকে ছেড়ে কেউ কখনো যায় ?
পারমিতা গদগদ স্বরে, রাকেশের বুকের উপর শুয়ে বলে,
- তুমি যদি আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাও আমি মরে যাব ।
রাকেশ, পারমিতার গালে ছোট্ট এক চড় মেরে বলে,
- পাগলী, এই কথা আর কক্ষনো বলবে না । তুমি আমার জান, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না ।
এইরকমভাবেই চলতে চলতে একদিন রাকেশ একটা চাকরি পেলো । কিন্তু সরকারি নয়, বেসরকারি । এটা শুনে পারমিতা দারুণ খুশি হল । রাকেশও ভাবলো এইবার জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া যাবে । দুই এক বছরেই পারমিতাকে সম্পূর্ণ নিজের করে নেবে । তখন লুকিয়ে লুকিয়ে আর দেখা করতে হবে না । কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না । দুজনে মিলে প্ল্যান করতে থাকলো, বাড়িটা কেমন বানাবে, কোন রং করা হবে, সন্তানের নাম কী রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ।
তারপর হঠাৎ একদিন, পারমিতার জামাইবাবু ওদের ব্যাপারে সবকিছু জেনে যায় । রাকেশের চাকরিও চলে যায় । রাকেশ ভেঙে পড়ে ভীষণ । পারমিতা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না । সে জানতো এরকম একটা দিন আসবে । সে রাকেশকে বলেছিলো আমাকে শত মারধর করলেও, আমাকে ঘরে বন্দি করে রাখলেও আমি তোমারই থাকবো রাকেশ । শুধু তুমি আমার সঙ্গে থেকো । আমি তোমাকে ভালবেসেছি তোমাকেই বিয়ে করবো । কিন্তু আজ পারমিতা সেসব কিচ্ছু করতে পারলো না । না তাকে মারা হয়নি, ঘরে বন্দি করে রাখা হয়নি । শুধু মগজ ধোলায় করা হয়েছে । তাকে দেখানো হয়েছে অঢেল টাকা পয়সা আর ক্ষমতার লোভ । রাকেশকেও তার জামাইবাবু খুন করে প্রমান লোপাট করেনি এমনকি কথাও বলেনি এ বিষয়ে । শুধু রাকেশের নামে বেশ কিছু মিথ্যে অভিযোগ টেনে এনে পারমিতার সামনে তাকে ছোট করা হয়েছে । জাতি কথা বারবার তুলে পারমিতাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে রাকেশের থেকে সে শত গুণে ভাল এবং ভাল ছেলে পারমিতার জন্য অপেক্ষা করছে ।
বাস্ খেলা শেষ । পারমিতা অন্ধ হয়ে গেলো । মেনে নিলো পরিবার, জামাইবাবুর কথা । সম্পর্ক ছিন্ন করে দিল রাকেশের সঙ্গে ।
হাজার অনুনয় বিনয় করার পরও পারমিতা রাকেশকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে । রাকেশ কান্নায়, বেদনায় বেশ কিছুদিন পারমিতাকে বোঝাতে থাকল । কিন্তু কে বোঝে ! লোভ যেখানে ওঁৎ পেতে বসেছে, সেখানে গরিব চাষীর ছেলের কথা মাটির সমান । টাকা থাকলে এরকম চাষীর ছেলের ভলোবাসা হাজার কেনা যাবে ।
শেষবার, পারমিতা বলেছিলো, আর জলভরা চোখে রাকেশ শুনেছিল শুধু,
- তোমার গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, চাকরি নেই, নীচু জাত, ফ্যামিলি ভাল না । তোমাকে আমি কিকরে বিয়ে করবো ? তোমার লাইফস্টাইল আর আমার লাইফস্টাইল অনেক আলাদা । আমাকে ভুলে যাও ।
এরপর রাকেশ আর কোনো কথা বলতে পারেনি । দুই এক বছর পরই সিদ্ধান্ত নেয়, জাত ধর্মের উর্দ্ধে গিয়ে সে ভালবাসা প্রমাণ করে দেখাবে । টাকা না থাকলেও যে ভালবাসা হয়, তাও প্রমাণ করবে, বাড়ি না থাকলেও যে বিয়ে করা যায় তাও প্রমাণ করবে । আর তাই, সেলিনাকে প্রথমেই বিয়ের প্রস্তাব রাখে রাকেশ । রাকেশের বাবা মা মেনে নেয় । সেলিনার বাবা মার কোনো আপত্তি নেই । সমাজ কী ভাবলো না ভাবলো তাতে কিচ্ছু যায় আসে না রাকেশের । কারণ সব কিছুর উর্দ্ধে ভালবাসা । একমাত্র ভালবাসাই পারে, জাতি ধর্মকে মিশিয়ে দিতে । যার মধ্যে ভেদাভেদ থাকে সে ভালবাসতে পারে না, কারণ ভালবাসাটা হৃদয় নিঃসারিত সেখানে টাকা পয়সা, ধন দৌলত, জাত পাত কাজ করে না ।