ছোটগল্প - মার্টিনা বাড়ি নেই
মেয়েদের যখন বয়স বাড়তে থাকে তখন হাজার সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । রাস্তা ঘাটে একা বেরোনোর জো নেই । বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকাও যায় না । আত্মীয়ের বাড়ি দু-চার দিনের জন্য গেলেও পাড়া-গাঁয়ে রটে যায় আকথা-কুকথা । তাছাড়া বাড়ির বড় মেয়ে হলে বোধহয় একটু বেশিই সহনশীল হতে হয় । শুধু কী তাই ! সমস্ত মেয়েলিপনা গোপন কুটিরে রেখে ধীরে ধীরে পুরুষও হয়ে উঠতে হয় । তেমনই হাজার হাজার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়ে উঠছে মার্টিনা । সংসার বলতে মার্টিনা নিজে একটা আদরের বোন আর বাবা মা । বাড়ির থেকে দশ কিলোমিটার দূরে মার্টিনার বাবার একটি তেলের কল আছে । সরিষা, তিল পিষে যা ইনকাম হয় তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে যায় । কিন্তু দু দুটো মেয়ের পড়াশোনা, বিয়ে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই । মার্টিনা সব বোঝে । পড়াশোনার পাশাপাশি হাতের কাজ করতে শুরু করে । মাঝেমাঝে তেল নুন আনার পয়সাটাও মার্টিনা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয় । বোনের হাতখরচ, স্কুলের বেতন এমনকি মাঝে মাঝে বাবাকেও বিড়ি কিনবার টাকাটা দিতে হয় মার্টিনার । কিন্তু মার্টিনার এইরকম ছোট কোনো হাতের কাজ করে পয়সা রোজগার করা একদমই পছন্দ ছিল না । প্রতিটি মেয়ের আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে, মার্টিনার স্বপ্ন অনেক আলাদা । আর এ জন্যই সে বোধহয় আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা । বন্ধু বান্ধবী সীমিত । যাঁরা আছে তাঁরা প্রত্যেকেই ভদ্র ও সভ্য । অতিরিক্ত মর্ডান বা আধুনিক গোছের মেয়েরা যেমন ভ্রু ফিলাপ করে, ঠোঁটে ক্যাটক্যাটে লিপস্টিক পড়ে, ছোট ছোট পোশাক পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে পাব এ যায়, রাত করে বাড়ি ফেরে – মার্টিনা তেমন কোনোদিন করার কথাটাও ভাবতে পারে না । আর এ জন্যই বোধহয় লোকে তাকে খারাপ বলে ! সন্ধ্যায় টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাতাল ছেলেরা পিছু নেয়, চায়ের দোকানের কাকুগুলোও আজকাল কেমনভাবে যেন বুকের দিকে তাকায় । সকালে কলতলার কাকিমারা মার্টিনাকে নিয়ে কথাবলাবলি করতে থাকে । কেউ কেউ বলে,
আর একজন তো বিশ্রী একটা শব্দ করে বলে,
“উঁউঁ..ওকে কোন ছেলে বিয়ে করবে শুনি ?”মার্টিনা, মাঝে মাঝে শুনেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়, চুপচাপ থাকে । তার কাছে প্রতিবাদ করার ভাষা নেই । মা বাবাকেও এসব কথা জানানো যায় না । পাড়ার লোকের মতো বাড়ির লোক জনও যেন কেমন হয়ে গেছে । ওকে কেউ বোঝে না একমাত্র ওর বন্ধু বাবাই ছাড়া । বাবাই মাঝে মাঝে মার্টিনাকে বলে,
“আমি ছাড়া তোমাকে আর কে ভাল বোঝে শুনি ?”মার্টিনা জানে, তাই হাসি মুখ লুকিয়ে বলে,
“হুঁ, অনেকেই আছে । আর আমি তো সবার মতো কঠিন না যে কেউ বুঝতে পারবে না । আমি হলাম নীলকণ্ঠ ফুলের মতো ।”বাবাই মৃদুস্বরে বলে,
“থাক হইসে আমার নীলকন্ঠী ।”বাবাই মার্টিনার খুব কাছের এক বন্ধু । বাবাই কী একটা কোম্পানিতে চাকরি করে । মার্টিনাও পড়াশোনা, সংসার সামলানোর পাশাপাশি হাতের কাজ করেই টাকা জমাতে শুরু করে । বহুবার বাবাইকে বলেও মার্টিনার জন্য সে তার কোম্পানিতে জয়েনিং এর সুযোগ করে দেয়নি । কিন্তু তাতে মার্টিনার ক্ষোভ নেই । মার্টিনা ওসব কাজ করতেও চায় না । ওর স্বপ্ন বড় অনেক বড় । কিন্তু এত সমস্যা নিয়ে মার্টিনা সেই স্বপ্ন কীভাবে পূরণ করবে ? মাঝে মাঝে চুপচাপ বসে ভাবে কীসব । ভাল লাগে না কিচ্ছু ।
ধীরে ধীরে বাবাই এর সঙ্গে মার্টিনার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গভীরে পৌঁছয়, একটা সুন্দর ভালবাসা তৈরী হয় দুজনের । দুজনেই স্বপ্ন দেখতে থাকে । চলতে থাকে জীবন । কিন্তু আমাদের মতো এরকম প্রেম নয় । মার্টিনার প্রেম গঙ্গাজল, শুভ্র পদ্মের মতো । ছোট থেকেই মার্টিনা নরম প্রকৃতির, বন্ধুসুলভ, মৃদুভাষী ।
হঠাৎ একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো । কোথায় মার্টিনার সেই স্বপ্ন, কোথায় মার্টিনার ভালবাসার মানুষ, কোথায় বন্ধু কে জানে । বিকালের রক্তিম আলো জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে । মার্টিনা বিছানায় শুয়ে, স্যালাইন চলছে । ডাক্তারবাবু এসে আবার পরীক্ষা করে গেলেন, যেতে যেতে বললেন,
“এ বয়সে এত দুশ্চিন্তা করলে মাথার ব্যামো হতে পারে । তখন রাঁচি ছাড়া আর গতি থাকবে না বুঝলেন”।বাবা মা চিন্তায় পড়ে গেলেন । একে সংসারের চিন্তা তারপর আবার ! মার্টিনার বাবা কখনো তার সঙ্গে ভালবেসে, আদর করে ডাকেনি, মনের কথা শুনতে চায়নি । বোঝেওনি মার্টিনা কী চায় । মার্টিনার দুঃখ অনেক । ও ভাবে, “এ রোগ থেকে আমাকে বেঁচে উঠতে গেলে আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে, এ পাড়া ছাড়তে হবে” । কিন্তু কোথায় যাবে, যার সঙ্গে একটা ছোট্ট সংসার গড়বার কথা ভেবেছিল, সেও তো আজ নেই । মার্টিনা ভয়ে কেঁপে ওঠে । মনে পড়ে যায় বাবাই এর সব কথা, বাবাই এর সেই চরিত্র । নিজের অজান্তেই চোখের জল মুছে নেয় মার্টিনা । ভাবতে থাকে, “আমাকে জবাব দিতেই হবে, পাড়ার লোক, বাবা মা, বাবাই আর সবাইকে জবাব দিতে হবে”।
বাবাই এর সঙ্গে মার্টিনার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে অনেক অপমান, ঘৃণা আর অবহেলা । বাবাইকে মার্টিনা যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা নয়, যেমনটা মানুষ মার্টিনা চায় তেমনটা মানুষ নয় ও । তবুও ভেবেছিল মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে চলবে, কিন্তু মার্টিনা মানিয়ে গুছিয়ে নিলেও বাবাই মানিয়ে নেওয়ার পাত্র নয় । উপরন্তু কৃপণ, ভীরু, অবোধ ও পাগলাটে ধরণের । একদিন বাবাই এর মা মার্টিনার সম্পর্কে অনেক খারাপ মন্তব্য করে বাবাইকে বলে,
“ও মেয়ের কী আছে যে তুই ওকে বিয়ে করবি, না তো করে চাকরি না আছে বাপের টাকা । অমন মেয়েকে বিয়ে করার চেয়ে কুকুরকে বিয়ে করা ভাল । তেমন তো দেখতেও নয় । কী দেখে ভালবাসলি তুই । ও মেয়েকে যদি তুই ঘরে আনিস তো আমি জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব এই বলে রাখলাম ।”বাবাই মার্টিনাকে ভালবাসলেও সে এত কথা মুখ বুজে শুনে গেছে, মার্টিনার দিকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেনি তার মায়ের বিরুদ্ধে । একসময় বাবাইও মার্টিনাকে খারাপ অভিযোগ দিয়ে দূরে সরে যায় ।
আজও সেই অপমান, সেই ঘৃণার কথা মনে পড়লে মার্টিনার চোখে জল আসে । কিন্তু কিছুই করার নেই । ভুল মানুষের সঙ্গে জোড় করে সম্পর্ক রেখে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে নষ্ট করে লাভ নেই । মার্টিনা এই সমস্ত কিছু ভুলে যাবার চেষ্টা করেও ভুলে যেতে পারে না । কিন্তু মনের ভেতর তার স্বপ্ন পূরণের অদম্য জেদ আর মানুষের তার প্রতি কিছু নিষ্ঠুর অপবাদ ও অপমান তাকে পৌঁছে দেয় সেই ঠিকানায় । কিন্তু পথ সোজা ছিল না, ছায়া ছিল না, সঙ্গি ছিল না । তবু ইচ্ছে যদি থাকে আকাশ ছোঁয়ার, পাখি হতে সময় লাগে না ।
মনের ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাইরে লিখে দিল “মার্টিনা বাড়ি নেই” । সারাদিন তারপর স্বপ্ন পূরণের প্রস্তুতি । সময় এসে গেছে বদলানোর । সময় এসে গেছে কিছু দেখানোর । জীবনটাকে শুধু শুধু অজৈব সার হতে দেওয়া যায় না । রাতের পর রাত দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর চলে গেল । মার্টিনাকে সবাই ভুলে গেল । বয়সটাও একলাফে অনেকটা বেড়ে গেল ।
পাড়া-প্রতিবেশী সেদিন খবরটা জানতে পারলো, যেদিন ধনী ব্যাবসায়ী মানিকলাল শেঠের তিনটে গাড়ি, ভর্তি করে লোক এলো মার্টিনার বাড়ি । মানিকলাল শেঠের ছোট ছেলে মুক্তার এর সঙ্গে মার্টিনার বিয়ের পাকাপাকি দেখা সাক্ষাতের জন্য, বিয়ের দিনক্ষণ স্থির হতেই যেন আকাশ হুমড়ি খেয়ে পড়লো মার্টিনার বুকে । এইতো চেয়েছিল মার্টিনা, জীবনটাকে যেন কোনও গাছতলায় পুঁতে দিতে পারে সে, যেন দীর্ঘদিন দীর্ঘকাল শুধু ছায়া দিতে পারে । খুশিতে গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে মার্টিনা । ছাদে গিয়ে একপ্রকার নাচতে থাকে । রাত করে বাড়ি ফিরলেও কেউ কিচ্ছু বলে না । মার্টিনার ভয়ও লাগে না ।
কলতলার সেই কাকিমারা আজ আর মার্টিনাকে নিয়ে কথা বলাবলি করে না, ওদের ভয় লাগে । চায়ের দোকানের কাকুরা মার্টিনার বুকের দিকে তাকায় না আর, ওদের ভয় লাগে । মাতাল ছেলেগুলোও আর পিছু নেয় না, ওদেরও ভয় লাগে কারণ মার্টিনা একজন পুলিশ অফিসার ।
সমাপ্ত